“চান্দ করে অপমান সহিতে না পারি।
ডুবাইব চান্দর নৌকা দেহ আজ্ঞা করি।।
চৌদ্দ ডিঙ্গা ডুবাইব সমুদ্রের ভিতর।
আমারে কর আজ্ঞা দেব মহেশ্বর।।”
“মনসামঙ্গল” কাব্যে উপরের লাইনগুলো রাগ এবং যন্ত্রণায় পদ্মাবতী বলছে মহেশ্বর শিবকে।
বাংলা সাহিত্যের শৈশবকালে রচিত হয় -পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল কাব্য। প্রণয়ন করেন কবিবর বিজয়গুপ্ত। সেই থেকে মনসামঙ্গলের গল্প বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে যায়। আমরা জানি বেহুলার কথা, চাদ সওদাগরের গল্পের কথা। সম্ভবত ১৪০৭ থেকে ১৪১৬ সালের দিকে এই গল্পগুলো বাংলাদেশে পরিচিত হয়। ২০২২ সালে এসে এতকিছু থাকতে এই কাব্যের লাইন দিয়ে কথাবার্তা শুরু করা আমার প্রয়োজন পড়লো কেন? সম্প্রতি “হাওয়া” সিনেমার সাথে আমাদের প্রাচীন এই গল্পের যোগসূত্র আছে। পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনও তেমনটিই বলেছেন। হাওয়া সিনেমা নিয়ে মুগ্ধতার শুরু আমার এখানেই।
হাওয়া সিনেমার পটভূমিতে আছে এক দল জেলে, তাদের মাছ ধরার নৌকা, মাঝমসুদ্রে জালে আটকে পড়া এক যুবতী, আর খোদ নীল এক সমুদ্র। জীবিকার সন্ধানে মহাজনের কাছ থেকে প্রায় দশ লাখ টাকার জাল নিয়ে জেলেরা সমুদ্রে নৌকা ভাসায়। এদের প্রধান মাঝি (চাঁনমাঝি) চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। চানমাঝির দৃষ্টি স্বচ্ছ, যে পানি দেখেই বলে দিতে পারে এখানে মাছ আছে কি নেই। সিনেমার প্রথম দিকে তার চোখের তীক্ষ্ণতা আর হাতের ইশারায় জাল ফেলে বাকি মাঝিরা। বাইরের মহাজন অন্যকেউ হলেও নৌকায় মহাজন চানমাঝি। সময়ে সময়ে সে তার অনুচরদের বিবেকহীন কথা শুনে বিরক্ত হয়। বাগেরহাটের ভাষায় বলে- কথাবার্তা হুস মতো কইস। প্রথমার্ধের পর এই চরিত্র হয়ে ওঠে দর্শকের চিন্তার মূল বিষয়। সে কেমন মানুষ, তার পরিণতি কেমন হবে- এটা সবাই অনুমান করে ফেললেও, আসলেই তার কারণে বাকিদের পরিণতি কি হবে তা বুঝতে পারা সোজা কথা ছিল না।
এবার আসি নাজিফা তুশির চরিত্রে। বলা যায় চানমাঝির চেয়ে এবং গল্পের সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র এই মেয়ে। নাম তার গুলতি। সে বাইদ্যার মেয়ে, ভয়েরেও ভয় করে না। ঘটনাচক্রে মাঝসমুদ্রে জেলেদের জালে আটকে যায়। জেলেদের সম্মতিতে নৌকায় থাকা শুরু করে। অনেকদিন সে কথা বলে না। সে যে কথা বলতে পারে তা একমাত্র জানে ইঞ্জিন মেকানিক ইবু ওরফে ইব্রাহিম (অভিনেতা শরীফুল রাজ)। সে আসলে কে? মানবী? নাকি মানবীর রূপে অন্য কিছু? এই প্রশ্নের জবাবে সে কেবলই হাসে। নৌকার মাঝিরা আর সিনেমার দর্শকেরা- এই দুই দলই এই রহস্যে দুলতে থাকে গভীর সমুদ্রে। গুলতি সবার সাথেই খোলামেলা ভাবে মিশতে পারে, আবার গভীর রাতে সমুদ্রের পানিতে গোসলের পর শাড়ি মেলে দিয়ে হাওয়ায় একান্তে কাপড় শুকোয়। এই সময়টা একান্তই তার একার। এখানে প্রবেশের অধিকার আর কারো নেই।
চরিত্র নিয়ে কথা বলা বাদ দিয়ে এবার অন্যদিক থেকে একটু ঘুরে আসি।
সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডঃ হাওয়া সিনেমার ভিজুয়াল অসাধারণ। । যে লোকেশনে হাওয়া নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে বর্তমান সময়ের ভাল মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে শুটিং করতে গেলেও ওয়াও ধরনের দৃশ্য থাকার কথা (আমি নিজে পড়ন্ত বিকালে সাগরের লাল নীল সোনালি আকাশের ফুটেজ নিয়েছি বলে বললাম)। তবে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই আসল কথা নয়, আসল কথা হলো পরিচালক আর সিনেমাটোগ্রাফারের মাথা। দুটোই ভাল জমেছে। বিশেষ করে মাঝ সমুদ্রে অন্য নৌকা বা অবস্থান থেকে তোলা মূল বোট, কিংবা কিছু POV শট (যেমনঃ প্রথম দিকে নোঙ্গর পানিতে যখন পড়ে, উরকেস পারকেস এর পানিতে ঝাপের সময়কার ঘটনা, ইত্যাদি)। ‘মনপুরা’, ‘স্বপ্নজাল’, ‘দেবী’, এর মতো সিনেমায় সিনেমটোগ্রাফার কামরুল হাসান খসরু এর আগেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, দিনে দিনে তাঁর হাত আরো পেকেছে। ট্রানজিশন গুলো চোখের এবং দর্শকের মস্তিকের জন্য আরামদায়ক ছিলো। এতে অবশ্য এডিটিং এর ভূমিকা আছে। সেটা নিয়েই বলছি এখন।
এডিটিংঃ সিনেমার একদম শুরুতে মাইকিং এর মাধ্যমে গল্প শুরু হয়। অত্যন্ত গতিশীল ট্রাঞ্জিশন, ফাস্ট মুভ- যেমন আজকাল ইউটিউবে সিনেমাটিক কিছু আরবান লাইফের কনটেন্ট দেখি, ঠিক সেরকম। দর্শককে প্রথমেই একটু চাঙ্গা করে দেয়ার জন্য, একটু আশার বানী দিতে ঠিক জেনো “এই তো চাই” রকম অবস্থা! তবে গল্পের একদম মাঝের দিকে আরেকটু সচেতন থাকা যেত বলে আমি মনে করি। শেষের দিকে আবার অবশ্য সেই গতি ফিরে এসেছিলো। হয়তো গল্পের কারণেই মাঝখানে একটু স্থিরতায় চলে এসেছে, তবে তা মোটেই কোন সমস্যা নয়।
মিউজিকঃ হাওয়া সিনেমার আবহ সঙ্গীত করেছেন রাশিদ শরীফ শোয়েব, এবং গানের সঙ্গীতায়োজন করেছেন ইমন চৌধুরী। সিনেমা মুক্তি পাবার আগেই “সাদা সাদা কালা কালা” এইগানটি বিখ্যাত হয়ে গেছে। সেটা নিয়ে কথা বলবো না। সেইসাথে বিখ্যাত হয়েছে মেঘদল ব্যান্ড থেকে ট্রিবিউট করা “এ হাওয়া” গান। এই গানটি বেশ কয়েকদিন ধরে আমার মাথার ভিতরে ঢুকে আছে। এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে আসলে পারসোনাল বায়াসনেস চলে আসবে। শুধুমাত্র একটি কথাই বলতে চাই- সিনেমার আবহসংগীত এর পরিমিত ব্যবহার। এম্বিয়েন্স সাউন্ড চমৎকার ছিল। মাঝে মাঝে মেয়ে কণ্ঠে মাঝ সমুদ্রে যে সংগীতের আবহ তৈরি করা হয়েছিল, তার মন প্রাণ আকুল করে দেয়ার মতোই ছিল।
ভিএফএক্সঃ যারা মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত মেঘদল ব্যান্ডের “এসো আমার শহরে” গানটির ভিডিও নির্মাণ দেখেননি, তাদের পক্ষে বুঝতে পারা কঠিন হবে, কোনটা আসল আর কোনটা গ্রাফিক্স দিয়ে বানানো! অসাধারণ পরিমিত ব্যবহার!
আবার চরিত্রঃ নাসিরউদ্দিনের করা নাগু নামের চরিত্রের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়, সুমন আনোয়ারের চরিত্রও ছিল অসাধারণ।পারকেস উড়কেসের রসায়ন দর্শককে আনন্দ দিয়েছে। একসময় পারকেস যখন বাঁচার আশায় সমুদ্রে লাভ দেয়, কল্পনায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে হারিয়ে যায় অতল জলে, তখন মন হুহু করে ওঠে। এই পারকেস চরিত্র করা মানুষটা আমার পূর্ব পরিচিত, তাকে কখনো দেখে মনেই হয় নি রিজভি ভাই এতো চমৎকার অভিনয় জানেন! শরিফুল রাজের অভিনয় যেমন চমৎকার, স্ক্রিপ্ট নির্বাচনও তেমনই। ইবু চরিত্রে তাকে মানিয়েছে, অজানা কারণে গুলতিকে সে রক্ষা করতে চায়। গুলতির থেকে চিরগোপন কথা জেনেও আর কাউকে তা বলেনি, কেন বলেনি তার উত্তর সে নিজেও জানতো না। মানব মানবীর এই পরম মমতার জন্যই হয়তো আমাদের পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল।
পরিচালক ও ভাল লাগার কিছু দিকঃ মেজবাউর রহমান সুমন এই গল্প আমাদের অনুমান করতে দেননি। সেটাই কেবল তাঁর স্বার্থকতা নয়। তিনি চমৎকারভাবে একটি গল্প বলেছেন, তাঁর মনের হাওয়া আমাদেরও লাগিয়ে আকুল করেছেন-এটাই মনে হয় আসল বিষয়। তাঁকে আমি দীর্ঘদিন থেকে চিনি। বহুকাল আগে আমি যখন “চিলড্রেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল” এ অংশ নিতাম, সেই সময় থেকে বেশ তাঁর কয়েকটা ওয়ার্কশপ আমি করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন মনে হতো এই লোকটা সিনেমা বানান না কেন? এই সিনেমা ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটা ভাল ভাল ফিকশন নিয়ে কাজ করেছেন। যারা হাওয়া এর মাধ্যমে তাঁকে চিনছেন, তাদের বলবো সুমনকে চেনার জন্য বাকি কাজগুলোও দেখা প্রয়োজন। যেমনঃ অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্প, তারপর ও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে, তারপর পারুলের দিন, অরুপার জন্য, এসো আমার শহরে (মিউজিক ভিডিও) ইত্যাদি।
হাওয়া সিনেমায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু এলিমেন্ট ছড়িয়ে প্রত্যেক চিত্রনাট্যকার আশা করি ভালই গল্প নিয়ে খেলে মজা পেয়েছেন। যেমন বলা যায়- সাপলুডু খেলতে দিয়ে সাপের মুখে পড়ে একে একে সবাই নিচে নেমে আসে, সিঁড়ি বাঁয় কেবল গুলতি। সিনেমার শেষে আমরা এর মর্ম বুঝতে পারি।
পোস্টারঃ হ্যাঁ, এটাও কথা বলার মতো জিনিস যা পরিচালক আগেই বলে দিয়েছেন- পোস্টারে রেনেসাঁ পরবর্তী আর্ট ফর্ম অনুসরণ করা হয়েছে। রিয়েলিজম (Realism) বলে যেই এলিমেন্ট আমরা রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে পাই, তা হাওয়া সিনেমার পোস্টারে বিদ্যমান বলা যায়। হাওয়া সিনেমার পোস্টারটি একটি হাতে আঁকা ছবি যা দেখতে একদম বাস্তব এর মতো। শুধু তাই নয়, চরিত্রের ভেতরে যে দ্বন্দ্ব, প্রত্যেকের সংকট সবকিছুই যেন পোস্টারে আছে যা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে হলে গিয়ে সিনেমার গল্প জানতে।
শেষ কথা বলতে গেলে হাওয়া সিনেমা আরেকটি জায়গায় বড় ভূমিকা পালন করেছে বাংলা সিনেমায়। সেটি হল প্রমোশন। চমৎকারভাবে হাওয়া সিনেমার পাবলিসিটি হয়েছে। ইনোভেটিভ কিছু পন্থা পুরো টিম নিয়েছে- যেমন, সহজ সাবলীল গান, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি তে কনসার্ট ও মতবিনিময়, রিক্সার পেছনে পেছনে পোস্টারিং, অনলাইন উপস্থিতি ইত্যাদি। সবকিছুর পেছনে ক্যাপ্টেন মেজবাউর রহমান সুমন ডেবিউ ফিল্মে জাহাজের সফল ক্যাপ্টেন এর মতই নেতৃত্ব দেখিয়েছেন।
দুর্বল দিকঃ দুর্বল কিছু দুর্বল দিক আছে তাই তা নিয়ে সমালোচনা করা আমার নিজের দুর্বল দিক বলেই বিবেচিত হবে!
Hawa
Year: 2022
Directed by: Mejbaur Rahman Sumon
Produced by: Shimul Chandra Biswas (executive producer)
(কোন তথ্য/ উপাত্তে ভুল চোখে পড়লে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে লেখককে জানানোর অনুরোধ জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে সংশোধন করা হবে।)