দেশ

1 Shares
0
0
0
1

নিজের দেশ মানে আসলে কি?

মাতৃভূমি? তার মানুষ? নাকি ভৌগোলিক আর রাজনৈতিক সীমারেখায় আটকানো পৃথিবীর বুকে কোন স্থান?

দেশকে সংজ্ঞায়িত করার পর্যাপ্ত জ্ঞান আমার নেই। মার্ভেল কমিকের Thor: Ragnarok সিনেমায় ওডিন বলেন, “Asgard is not a place, it’s a people.” এই লাইনটা আমার খুব পছন্দের। তবে এটাও নিজের দেশের পুরো সংজ্ঞা হতে পারে না। বাংলাদেশের সব মানুষকে যদি পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে সরিয়ে নেয়া হয়, তবে কি সেটা বাংলাদেশ হয়ে যাবে? বাংলাদেশের নদী না থাকলে, কাদামাটি আর সর্ষের মাঠ না থাকলে, এমন চমৎকার বৃষ্টি আর কোলাব্যাঙের ডাক না থাকলে- বাংলাদেশ হবে কিভাবে?

সেন্ট মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে গেলে সেখানে নানা ধরনের মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ। কারো সাথে নতুন পরিচয় হলেই বাংলাদেশ নামের যে ছোট দেশ আছে, সেটা তারা জানে কিনা- এই প্রশ্ন দিয়ে আমার কথা শুরু হয়। অনেকেই আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে, “হ্যাঁ অবশ্যই! কেন চিনবো না!” আবার অনেকেই অবাক হয়ে বলে, “এটা কি ইন্ডিয়ার কোন অঙ্গরাজ্য?” তারপর আমি মোটামুটি ছোটখাটো ইতিহাসের ক্লাস খুলে বসি। ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের দখল, ভারত-পাকিস্তান, পাকিস্তান-বাংলাদেশ, ১৯৫২ আর ১৯৭১ সালের কাহিনী দিয়ে বলি, “আমি এই বঙ্গদেশের গর্বিত সন্তান!”

ইংল্যান্ডে অনেক ভারতীয় থাকার পাশাপাশি, পাকিস্তানীও আছে প্রচুর। অনেকেই আছে যাদের জন্ম এখানে, এমনকি তাদের বাবা মা-ও এই ইংল্যান্ডেই জন্ম নিয়েছে। তাদের একজন আমার ক্লাসে লেখাপড়া করে। মেয়েটার নাম ইউসরা। তার নানা নানী বহু বছর আগে পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ডে এসে স্থায়ী হয়েছেন। ইউসরার মায়ের জন্মও হয়েছে এই দেশেই। তার সাথে যখন একদিন বাসের জন্য স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছি, বাংলাদেশের কথা উঠে গেলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি জানো বাংলাদেশ একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিলো?” সে অবাক হয়ে বললো, “না তো!” তারপর আমি তাকে পাকিস্তান বাংলাদেশের ইতিহাসের উপর ছোটখাটো লেকচার শুনিয়ে দিলাম। তাকে আর দোষ দিয়ে কি লাভ! স্বয়ং পাকিস্তানে যাদের জন্ম তারা কি কখনো তাদের পূর্ব-ইতিহাস জানতে পারে? এমনকি বাংলাদেশ থেকে যারা এসে এখানে স্থায়ী হয়েছে, তাদের ঘরের কয়টি স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে বাংলাদেশের সাধারণ ইতিহাস জানে? (এটা নিয়ে ভাল একটা জরিপ করা যেতে পারে।)

বাংলাদেশকে যে পৃথিবী একদমই চিনে না তা কিন্তু নয়। আমার ক্লাসে দুটো মেয়ে, হানাহ- যার বাড়ি সুইজারল্যান্ড, আর কেলসি- যার বাড়ি আমেরিকা, তারা দুজনে বাংলাদেশকে যে শুধু চিনে তা নয়, স্বয়ং একসময় তারা বাংলাদেশে থাকতো। এই ঘটনাটা বলি। ভার্সিটির প্রথমদিন পরিচিতি পর্ব শেষ করে ক্লাস থেকে বের হয়েছি। হানাহ নামের মেয়েটা এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বললো, “তুমি বাংলাদেশী? আমি একসময় ঢাকায় ইন্টার্নশিপ করতে গিয়েছিলাম। তা অনেক বছর আগের কথা। তোমাকে দেখে আমার খুবই ভাল লাগছে। ঢাকাকে আমি অনেক মিস করি।”

আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললাম, “বলো কি!”

– হ্যাঁ! ঢাকায় কি যেনো একটা মার্কেট আছে, অনেক জ্যাম থাকে রাস্তায়-এখানে প্রায়ই আমি যেতাম।
– নিউ মার্কেট?
– ইয়েস! ওখানে রাস্তায় অনেক ভাল স্ট্রীটফুড পাওয়া যায়। আমার এখনো সেখানকার কথা মনে পড়ে।
– তুমি কি ফুচকা, ঝালমুড়ির কথা বলছো?
-সম্ভবত!

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কেলসি এসে খোদ বাংলা ভাষায় বললো, “বাংলাদেশে তোমার বাড়ি কোথায়?”

ইয়া আল্লাহ! এ আমি কোথায় আসলাম? আমেরিকান সুন্দরীর মুখে শুদ্ধ বাংলা! জানতে পারলাম, কেলসি দুইবছর চট্রগ্রামের এক ইউভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছে এবং বান্দরবন ছাড়া প্রায় সবগুলো দর্শনীয় স্থানে তার ঘুরাঘুরি শেষ! বাংলাদেশের খাবার সম্পর্কে রাফসান দ্যা ছোটভাইয়ের মতোই ভাল রিভিউ কেলসি ঝেড়ে ফেললো। তার ভাষার দক্ষতাও যে অসাধারণ তা আমাকে স্বীকার করতেই হলো। এরপর থেকে আমি খিচুরি, বিরিয়ানি সহ নানা বাংলাদেশী খাবার, মানুষের পোশাক সম্পর্কে রীতিমতো গুগল সার্চ করে করে সবাইকে দেখাই আর বলি, সময় হলে একবার বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসতে পারো!

 

কিছু কিছু বিষয় আছে যা নিজের দেশে বাস করে অনুভব করা যায় না। এই তালিকায় আমাদের কিছু স্বভাবও আছে। উদাহরণ ছাড়া বিষয়টা পরিষ্কার হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানেও রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এর কিছু কাজ লাঞ্চের পরে হয়। যেমন বায়োমেট্রিক কার্ড কালেকশন। আগে গেলে আসলেই আপনাকে বলবে, “দুপুর দুইটার পরে এসো!” একদিন ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে নামছি। এক ভারতীয় ছেলে উপরে উঠতে গিয়ে আমাকে দেখে ইংরেজিতে বললো, “কাজ কি শুরু হয়েছে?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। তুমি যেতে পারো।”
ছেলেটা আরাম করে বললো, “ইন্ডিয়ান?”
– না, আমি বাংলাদেশী।

বাংলাদেশী শুনেও  ছেলেটা আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলা শুরু করলো। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। আমি কোন হিন্দি না বললেও ছেলেটা ধরেই নিয়েছে আমি হিন্দি বুঝতে পারি। বাস্তবতা হলো আমি আসলেই হিন্দি বুঝতে পারি। ছোটবেলা থেকেই হিন্দি চ্যানেলগুলোর কল্যানে হিন্দি ছবি দেখে অভ্যাস, বুঝানোর মতো হিন্দি বলতেও পারি। কিন্তু সেদিন আমি কোন হিন্দি শব্দ উচ্চারণ করলাম না। সেদিন আমার ছেলেটার আচরণ ভীষণ গায়ে লাগলো। কেন? কারণ, ছেলেটার চেহারা দেখে আমার মনে হয়েছে সে ধরেই নিয়েছে তাদের কন্টেন্ট হজম না করলে আমাদের ঘুম হয় না, কাজেই সে তার ভাষায় কথা বললেও আমি বুঝতে পারবো। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে তাকে প্রশ্ন করলাম, “তুমি কিভাবে বুঝলে আমি হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারি?”

ছেলেটার উত্তর আর লিখার প্রয়োজনবোধ করছি না। কেননা আমি যেটা ভেবেছি তার কথার সারাংশ সেটাই। ছেলেটাকে আমি কোন দোষ দেই না। তার চিন্তাটা খুবই সাধারণ আর লজিকাল থিংকিং। আমরা প্রচুর পরিমাণে হিন্দি ভাষার কন্টেন্ট দেখি। বলিউড সিনেমা দেখা অবশ্যই মজার একটা জিনিস। কিন্তু প্রায়ই আমি এইসব সিনেমাতেও বাংলাদেশকে ছোট করে অনেক কিছু করতে দেখি। তা হয়তো আফ্রিকান কিছু দেশ নিয়ে আমরাও করি। কিন্তু আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আর বিজয় নিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে যে চিত্র প্রতিনিয়ত আঁকা হয়, বাংলাদেশী হিসাবে তা মেনে নেয়া হতাশার আর জিদের কারণ।

আচ্ছা, এই যে একটি জায়গাকে হেয় করে কেউ দেখলে মনে হয় আমাকেই কেউ হেয় করছে, যে জায়গার মানুষকে কেউ কিছু বললে মনে হয়, আমাকেই কেউ অপমান করছে, সেই জায়গাটাকেই তো “দেশ” বলে, তাই না? 

1 Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *