২০২২ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের একদম খারাপ অবস্থা। সোশ্যাল মিডিয়াতে অসহায় মানুষের ভয় আর বন্যার পানির প্রবাহ দেখে সারাদেশের মানুষের মন খারাপ। অনেক সেলিব্রেটি মানুষও কোমর বেঁধে সিলেট এলাকায় গিয়ে ত্রাণ কার্যক্রমে যোগ দিয়েছে। সিলেটের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, রাস্তা-ব্রিজ ভেঙ্গে মানুষের চলাচল বন্ধ। এদিকে দেখা গেলো যাদের নিবাস একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তাদেরকে পারাপারের জন্য মাঝিরা পাঁচ হাজার, দশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত চেয়ে বসছে। শুনে মনটা একটু বেশিই খারাপ হয়ে গেলো।
মন খারাপের আরেকটা কারণ আছে। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন আগেই পুরনো বন্ধুরা মিলে জয় স্যারকে ধরে বেঁধে জোছনা রাতে টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রাজী করিয়েছিলাম। ইদানীং বড় বড় বজরা টাইপ নৌকা পাওয়া যায়। নৌকার ভিতরে বসে এক হাতে বই আরেক হাতে চায়ের কাপসমেত বাইরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভাল এস্থেটিক ছবি তোলা যায়। কিন্তু দেখা গেলো পূর্নিমার রাতে ট্যুর মিলাতে গিয়ে নৌকার ডেটই মিললো না। নৌকা আগে থেকেই বুকিং করে সাফা করে দিয়েছে বর্ষাবিলাসীদের দল। শেষ পর্যন্ত প্ল্যান বাদ পড়লো। সাথে এলো বন্যার সংবাদ। মিরপুরের বাসায় বসে যখন এইসব নিয়ে চিন্তা করছি, ঠিক তখন আমার অফিসের সুপারভাইসর ‘বিয়ানকা’ ফোনে বললো, “তুমি কি সিলেটে গিয়ে কিছু কেস স্টোরি আনতে পারবে?” আমি বললাম, “অবশ্যই পারবো।”
একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থায় কাজ আমার। ডোনার এজেন্সি হিসাবে বাংলাদেশে এদের কোন অফিস নেই। বাংলাদেশের কিছু সহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ পরিচালনা করা হয়। আমাকে ছয় মাসে একবার দুইবার ফিল্ড ভিসিটে গিয়ে কিছু ভিডিও কেস স্টোরি আর বেনিফিসিয়ারি ফিডব্যাক নিতে হয়। বাকি সময় বাসায় বসে রিমোট জব করি। প্রতিদিন জ্যাম ঠেলে বাইরে যেতে হয় না- আলহামদুলিল্লাহ বড়ই আরাম।
বিয়ানকা দুইদিনের মধ্যে আবার ফোন দিয়ে বললো, “তুমি কি এরমধ্যেই সিলেটে যেতে পারবে?”
এই দুইদিনের মধ্যে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি বললাম, “বাস চলবে না। যাবো কিভাবে?”
– বাস কেনো? ফ্লাইটের টিকেট ম্যানেজ করে দিচ্ছি।
– ফ্লাইটও যাবে না। বৃষ্টিতে এয়ারপোর্টের রানওয়েতে পানি উঠে গেছে।
– বলো কি!
– জি।
আরো কিছুদিন চলে গেলো। সিলেটের বদলে নেত্রকোনায় যাওয়ার ডেট পাকা করা হলে সময়মতো ট্রেনের টিকেট কেটে ফেললাম। আমার বন্ধু আজমান- যে প্রায় প্রতিটি দূরের জার্নি এবং ডকুমেন্টারির কাজে আমাকে সঙ্গ দেয়, সে তখন তার নিজের অফিসের কাজে অন্য এক জেলায় গিয়ে বসে আছে। ঠিক হলো কাজ শেষে দুদিন পরে আমার সাথে সরাসরি নেত্রকোনায় এসে যোগ দেবে। আমি দিনমতো ব্যাগ গুছিয়ে সকাল সকাল কমলাপুরের উদ্দ্যেশে বের হলাম। মিরপুর থেকে উবার নিয়ে কমলাপুর আসতে রীতিমতো আমার বারোটা ছাড়িয়ে চৌদ্দটা বেজে গেলো। ট্রেন মিস করার বিরাট আশংকা দেখে আমার ততক্ষণে হৃদকম্পন প্রবাহমান। কমলাপুরে পা রাখার সাথে সাথে পরিচিত কয়েকজন কমবয়সী কুলি দেখতে পেলাম। কাজের সুবাদে ফিল্ড ভিসিটে প্রায়ই আমার এই স্টেশনে আসতে হয়। এই কারণে কমলাপুর স্টেশনের অধিকাংশ কমবয়সী ছেলেকেই আমি চিনি, তারাও আমাকে চেনে। তাদের নিয়ে অনেক ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে। সেই গল্প আরেকদিন লিখবো। একটি ছেলে আমাকে দেখে ব্যাগ নিতে দৌড়ে আসতেই দুইটা ব্যাগের একটা ব্যাগ ওর হাতে দিয়ে আমিও দৌড়াতে লাগলাম ট্রেন ধরতে। প্ল্যাটফর্মে ঢুকবার আগেই সাগর নামে ছেলেটার (নাম সম্ভবত ঠিকই লিখেছি। আমি সহজে নাম মনে রাখতে পারি না) কাছ থেকে জানতে পারলাম, ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে মাত্র দুই মিনিট আগে। সাগরকে দেখে মনে হলো আমার চেয়ে সে ই বেশি দুঃখী। এদিকে আসছানিয়া মিশনের (যাদের মাধ্যয়ে এই প্রজেক্ট করা হচ্ছে) এক গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই, ট্রেনে উঠেছেন?”
– না ভাই। মিস করেছি দুই মিনিট হলো। (ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে সবাই সবাইকে ভাই বলে ডাকে। হয়তো দেখা যাবে বয়সে আমি লোকটার ছেলের বয়সী।)
– আহা ভাই! এখন কি করবেন? (কথা শুনে কিন্তু মনে হলো আমি ট্রেন মিস করায় ভদ্রলোক খুব মজা পেয়েছেন!)
কিছুক্ষণ ঝিম ধরে রেস্টরুমে বসে থাকার পর খারাপ লাগার বদলে কি করে ঢাকা থেকে নেত্রকোনা পৌছাবো সেটা ভেবেই রোমাঞ্চিত হলাম। ঠিক করলাম মহাখালী থেকে বাসে করে চলে যাবো। ভেঙ্গে ভেঙে যেতে হবে, কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। মহাখালী থেকে প্রথমে যেতে হবে নেত্রকোনা বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে আরো দেড় দুই ঘণ্টা পর পৌছাবো মোহনগঞ্জ উপজেলা। সেখানে আগে থেকে আমার জন্য হোটেল ঠিক করে রাখা হয়েছে। বাস গাজীপুরের দিকে আগাতেই আমার মাথায় রাসেল আকন্দের নাম ভেসে এলো। রাসেল আকন্দ- আমার ইউনিভার্সিটির আরেক বন্ধু যার বাড়ি ময়মনসিংহ। যে বাসে যাচ্ছি, সেটা ওর বাড়ির সামনে দিয়েই যাবে। ও যদি এখন ভাগ্যক্রমে বাড়িতে থাকে, তাহলে ওকে তুলে নিলে কেমন হয়? মন বললো, অবশ্যই ভাল হয়! সাথে সাথে রাসেলকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে বললাম, “চলো বন্ধু ঘুরে আসি কয়েকদিন!”
রাসেলও আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে ময়মনসিংহ হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার একটা ফোনকলে কেউ দুই তিনদিনের জন্য আমার সাথে ঘুরতে চলে আসছে- ভাবতেই মনটা ভরে গেলো। বন্ধু রাসেল সমেত যখন নেত্রকোনা পৌঁছেছি, রাত তখন দশটা। সিএনজি যাত্রার অভিজ্ঞতাটা একটু বলি। সিএনজির পিছনে আমি আর রাসেল বসে আছি। সম্ভবত অমাবস্যা, কারণ বাইরে অনেক চেষ্টা করেও কিছু দেখতে পারছি না। লম্বা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে চোখে একটু তন্দ্রা এসেছে। ঠিক তখন নাকে এলো পরিচিত এক ঘ্রাণ। আশেপাশের জলাশয়গুলোতে পাট তলিয়ে রাখা হয়েছে। পুরোপুরি পচেনি, কিন্তু একটা মোহমোহ গন্ধ বাতাসে বয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই গ্রামের খোলা রাস্তার শীতল বাতাস, তার উপরে দুইপাশে এমন মোহের গন্ধে আমি আর রাসেল দুইজনই আবেগী হয়ে বাইরে চেয়ে রইলাম। তখন কিন্তু আর অন্ধকার নেই, আমরা দুজন অপলক সব দেখতে পারছি, অনুধাবন করতে পারছি। আজ মনে পড়লে মনে হয় সেটা সম্ভবত চোখ দিয়ে দেখিনি, হয়তো অন্য কোন ইন্দ্রিয় দিয়ে অপূর্ব দৃশ্যটা দেখেছিলাম।
পরদিন সকালে সরাসরি আসছানিয়া মিশনের আমির ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। লোকটি আসলেই আমার বাবার বয়সী! তিনিই আমাকে স্থানীয় চেয়ারম্যান আর ইউএনও এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রুট লেভেলে কাজ করা মোটেও সহজ কথা না। এলাকায় সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হয়, এখানে একা মানেই বেঁকা। ত্রাণ দেবার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ঠিক করা হয়েছে, কারণ বড় জায়গা, চেয়ারম্যান সব তদারকি করবেন। কারা ত্রাণ দিচ্ছে- গ্রামের মানুষ এতকিছু বুঝে না, তাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও নিজেদের প্রচার করার বিরাট সুযোগ থাকে। ত্রাণ নিতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছে। যাকে বলে- আবাল বৃদ্ধ বনিতা। সেই সকাল থেকে তারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, সবাইকে লিস্ট ধরে ধরে জিনিস বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমীর ভাইয়ের পরিকল্পনা আর তৎপরতা দেখে আমি আসলেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, “আপনি আসবেন দেখে আজকের দিনটা ঠিক করে রেখেছি। ডোনারদেরকে জানাবেন কেমন দেখলেন। বানিয়ে বলতে হবে না ভাই। যারা ত্রাণ নিতে এসেছে তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন কেমন হয়েছে আয়োজন। এর আগে এতো ত্রাণ এই এলাকার কোন মানুষ পায়নি। আশেপাশের এলাকায় হইচই পড়ে গেছে।”
যাচাই করে দেখলাম কথা সত্য। যে পরিমাণের চাল ডাল ঔষুধ আর অন্য রসদ দেয়া হয়েছে, তাতে ছোট পরিবারের প্রায় একমাস চলে যেতে পারবে। কিন্তু লাইনে দাঁড়ানো এতো মানুষ দেখলে মনটা হুহু করে উঠে। অনেকে দূর থেকে নৌকা ভাড়া করে দল বেঁধে এসেছে। পুলিশের লোকজন ভীড় কমাতে অনবরত বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এসেছেন একা, যাঁদের আর কেউ নেই, চালের বস্তা টেনে নিতে পারছেন না। এক বৃদ্ধা এসেছেন একা, তিনি চোখে দেখতে পান না। কেউ এসেছে একদম না খেয়ে। জ্বর নিয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে দুইজন মাথা ঘুরে পড়েও গেছে। প্রথমদিনেই এরকম অসংখ্য মানুষের ভীড়ে আমার মনটা বেদনায় ভরে উঠলো।
এর ঠিক দুইদিন পর আমরা ট্রলার নিয়ে ডিঙ্গাপোতা হাওরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে উপস্থিত হলাম। উদ্দেশ্য, কেস স্টোরি জোগার করা। সেই গ্রামের ঘরবাড়ি দেখে চমকেই উঠলাম। ঘরের নিচে মাটি বন্যার পানিতে ধসে গেছে, এখনো কাদামাটি শুকোয় নি। এরমধ্যেই মানুষ আর পোষা গরুছাগলের বাস। গ্রামের অনেকে তাদের স্ত্রী সন্তান আত্মীয় কিংবা শ্বশুরবাড়িতে (যেখানে পানি কম) রেখে এসেছে, ঘরটাকে কোনরকম টিকিয়ে রাখতে নিজে থেকে পাহারা দিচ্ছে।
পরেরদিন গেলাম আরো বিবর্ন জায়গায়। সেটা গ্রামও না, হাওরের মধ্যেখানে ১০০০ স্কয়ার ফিটের মতো একটা উঁচু জায়গা, তাতে কেবলমাত্র একটা ঘর, চারপাশে ধুধু পানি। যে শৌচাগার ছিল, তা বন্যায় ভেঙ্গে গেছে। এখন একরকম কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। এরকম কয়েকটা ঘরের দেখা মিললো হাওরে।
লেখা কি বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে? সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষের বেশীক্ষণ লেখা পড়তে ভাল লাগে না। আমার ভাটি অঞ্চলের এই স্মৃতি বেদনার। তবে মন ভাল করা একটি দিনের স্মৃতি অবশ্য আছে। সেটা দিয়ে আজকের মতো লেখা শেষ করি। কাজের ফাঁকে একদিন আমি, আজমান আর রাসেল মিলে কলমাকান্দা- পাঁচগাঁও বর্ডার রোড ঘুরতে গেলাম। যেতে যেতেই প্রায় সন্ধ্যা। ভাটি অঞ্চলের দেশ মনে হয় একেই বলে। ভারত সীমান্তে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ের কোলে এসে আমরা তিনজন একটু থামলাম। কোথায় যাবো জানি না। তিনজন যেদিকে দুচোখ যায়, হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু কোনরকম আগাম জানান না দিয়েই আমার জুতার ফিতা ছুটে গেলো। তবু আমরা ক্ষ্যান্ত দিলাম না। খালি পায়ে আর নীল পাঞ্জাবী গায়ে (একটুর জন্য হিমু হতে পারলাম না) আমরা ক্ষেত, বাঁশবাগান ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছি এক বিস্তর প্রান্তরের দিকে। জায়গাটা অপার্থিব। সেখানে আছে গারো সম্প্রদায়ের বসতি। প্রায় অন্ধকার নেমেছে। আচমকা খেয়াল করলাম পাশ দিয়ে ঝিরিঝিরি শব্দে ছোট একটা ঝিরিপথ বেয়ে গেছে। ঝিরিপথের পানি স্বচ্ছ ও শীতল। নিচের কচি পাথরগুলো অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। ভুবনকে ভুলিয়ে দেয়া এমন এক সন্ধ্যায় এই জলে পা না নামিয়ে থাকা যায়?