অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাহ বাস করে বুয়েটের একটি বাড়িতে। খাসা বাসা। জানালা দিয়ে জগন্নাথ হল দেখা যায়। তবে প্রায়ই দেখা যায় কেউ না কেউ আন্ডার গারমেন্টস ঝুলিয়ে রাখে। আজ তার মন একটু চিন্তিত। সেদিন ৭ মার্চের পর ছাত্রলীগের ছেলেপুলের চাপাচাপিতে বংগবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন,
“‘নুরুল উল্লাহ, আমাকে একটা ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে হবে। আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমাকে কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরি রাখবে। আমি শেষবারের ভাষণ দিয়ে যাব”।
নুরুল উল্লাহ পড়লো ভেজালে। এরকম ট্রান্সমিটার বানানো তার বা হাতের খেল। কিন্তু এমন একজন মানুষ তাকে কাজটি করতে দিয়েছেন, ভাবতেই উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে গেল। নুরুল উল্লাহ বুঝলো দেশের অবস্থা বেগতিক। আজকেও এমন উত্তেজনা অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হবে। আলমারিতে রাখা ভিডিও ক্যামেরাটি সে বের করে ঝেড়ে মুছে রাখলো। ইদানিং তার সবকিছু ধরে রাখতে ইচ্ছা করে। আইনস্টাইন কি ক্যামেরায় বন্দি সময়ের রিলেটিভিটি নিয়ে কিছু বের করেছেন? একটু ঘাটাঘাটি করা দরকার। গভীর রাতে নুরুল উল্লাহর ঘুম ভেংগে গেল। গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। পাক সেনারা টহল দিতে দিতেই ঠাশ ঠুশ করে গুলি ফোটায়। বন্দুক থাকলে হাত নিশপিশ করেই। বুয়েটের ছেলেরাও আজকাল হাতবোমা বানাচ্ছে। কি আজব। সোনার ছেলেরা কই লেখাপড়া, গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, মাথাটা কাজে লাগাবে। আর কই বানাচ্ছে হাতবোমা। সেগুলা আবার ফুটাচ্ছে নাকি? নুরুল উল্লাহর চিন্তা বাড়তে থাকলো। রাত বাড়ার সাথে সাথে চিন্তাও বাড়তে থাকলো। বাইরে আগুনের মতো বিষ্ফোরণ হচ্ছে। গুলির শব্দ বাড়ছে। জগন্নাথ হলের ভেতরে গুলির শব্দ বেশী। নুরুল উল্লাহ মালাঊনের সন্তানদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো। সব দোয়া পড়ে ফেললো। দোয়ার ভান্ডার শেষ। তবে রাত এখনো বাকি। থিওরি অব রিলেটিভিটি। নুরুল উল্লাহ মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো আজকে কত তারিখ? অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর তারিখটা মনে পড়লো, ২৫শে মার্চ। ১৯৭১। ২৬ মার্চ সকাল ৮টা। নুরুল উল্লাহ তার ক্যামেরাটা কালো কাপড়ে ঢাকলো। তার জানালার ফাক দিয়ে ক্যামেরাটা সতর্পনে তাক করলো জগন্নাথ হলের দিকে। নুরুল উল্লাহ দেখলো ছেলেগুলোকে এক ধার থেকে গুলি করা হচ্ছে। আম গাছের আম পড়ার মতো একজন একজন করে পড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের আর কোন ক্যাম্পাসে কোন গনহত্যা হয়েছে কিনা সে মনে করতে চেষ্টা করলো। মনে পড়লো না। নুরুল উল্লাহ ধারণ করলো সমগ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্যে গণহত্যার একমাত্র দলিল।
ইতিহাসভিত্তিক এই গল্পটি লেখা হয়েছে রাশীদুল হাসান কর্তৃক অধ্যাপক নুরুল উল্লাহর সাক্ষাৎকারের আলোকে।