“এক্সকিউজ মি স্যার! আপনার থেকে একটা সিংগারা পেতে পারি কি?”
কলাভবনের পাঁচতলার পরীক্ষার হলের সব ছাত্রছাত্রী খেয়াল করলো, ঠিক সামনের বেঞ্চে বসা রাশেদ তাদের ইনভেস্টিগেটর স্যারের কাছে সিংগারা খাওয়ার বায়না করেছে।
স্যার একটু আগে চারতলার মেয়েদের কমনরুম থেকে গরম গরম সিংগারা আনিয়েছেন। একটা শেষ করে আরেকটা শুরু করতে যাচ্ছিলেন। আচমকা সামনের বেঞ্চের এই ছাত্রটির কথা শুনে হাত থেকেই সিংগারাটা টুপ করে পিরিচের উপর পড়ে গেল।
– সিংগারা খাবে? সকালে নাস্তা করে আসো নি?
– না স্যার৷ এত সকালে পরীক্ষা। ঘুম থেকে উঠেই দৌড় মারলাম। এখন আপনার খাওয়া দেখে পেটের মধ্যে ভুটভুট করছে। এই যে আবার করছে!
– কাছে আসো। নিয়ে যাও।
– ধন্যবাদ স্যার!
রাশেদ উঠে স্যারের কাছ থেকে সিংগারা নিয়ে এসে বেঞ্চে বসে আরাম করে খেতে লাগলো।।খাওয়া শেষে হাত ঝাড়া দিয়ে বললো, পানি?
স্যার রুমের পিয়নের দিকে চাইতেই পিয়ন এক গ্লাস পানি এনে দিল।
– স্যার, আপনার অশেষ দয়া!
– চুপচাপ লেখা শুরু করো। কথা বন্ধ।
আমাদের ভেতর অলরেডি চোখ চাওয়াচাওয়ি শুরু হয়ে গিয়েছে। রাশেদ বরাবরই ফান করতে ভালবাসে। তাই বলে পরীক্ষার হলে অন্য ডিপার্টমেন্ট এর স্যারের কাছ থেকে সিংগারা চেয়ে খেয়ে ফেলবে, এমনটা আমাদের ভাবনাতেও আসে নি।
পরীক্ষা শেষে স্যার খাতা গুনছেন। রাশেদ স্যারের কাছে গিয়ে বললো, স্যার, আসলেই থ্যাঙ্ক ইউ! আমি আপনার ফ্যান হয়ে গেলাম। এই নেন আমার কার্ড। যদি কখনো কোন প্রয়োজনে লাগি, ফোন করবেন।
এবার স্যার চশমা বাঁকা করে কার্ডটা ধরলেন।
“রাশেদ আল মামুন
ডিজিটাল সবজিওয়ালা।
মোবাইলঃ **********
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে হলে খুচরা মূল্যে টাটকা বাজার সাপ্লাই দেয়া হয়।”
স্যার অবাক হয়ে বললেন, তুমি আসলেই সবজি সাপ্লাই দাও?
-জি স্যার। এন্টারপ্রেনিউরশিপ। দরকার হলেই ফোন দিবেন। বাজার সদাই যা লাগবে আমিই করে দিব। একদম বাজারের নির্ধারিত মূল্যে। ডেলিভারি চার্জ মাত্র ৫০টাকা। লস নাই স্যার। আপনি রিক্সা করেও পলাশি গেলে আসা যাওয়ার ভাড়া এমনই লাগবে। তাছাড়া আপনি শিক্ষক মানুষ, দামাদামি করতে পারবেন না, সারাজীবন লেখাপড়া করেছেন, বাজার সদাই ঠিকমতো নাও চিনতে পারেন। সেইদিক থেকে দেখলে আমার আছে দীর্ঘ এক যুগের অভিজ্ঞতা।
বলেই নায়ক রিয়াজের মতো মাথাটা ঘাড়ের দুইদিকে দুইবার নিয়ে লাজুক হাসি দিল রাশেদ।
-বেশ বেশ! তোমার কার্ডটা আমি রাখলাম।
-জি স্যার, আপনি সত্যিই মহান শিক্ষক। ছাত্রদের জন্য ইন্সপিরিশন…
-এবার যাও। কাজ করতে দাও।
……….
পূর্ণিমার রাতে জসিমুদ্দিন হলের মাঠে আমি আর রাশেদ আকাশের দিকে তাকিয়ে সবুজ ঘাসে গড়াগড়ি করে শুয়ে আছি আর হিসাব করছি পাশের আম গাছগুলোর আম পাকতে কতদিন লাগতে পারে। একদিন আম গাছটা সাফ করে ফেলতে হবে। আমগুলো এত বড় হয়েছে, এই রাতের চাঁদের আলোতেই চকচক করছে।
রাশেদ বললো, “ভালোই হবে। আমগুলো নিয়ে সেগুলোকে হলে হলে ডেলিভারি দিব।”
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, “ধরা পড়লে?”
আরে বেকুব, এই আম তো ক্যাম্পাসের আম। ক্যাম্পাসের সব ছাত্রদেরই এর উপরে একটা দাবী আছে। সেখান থেকে আমাদের কিছু পয়সা হলে ক্ষতি কি?
এমন সময় রাশেদের মোবাইল বেজে উঠলো।
-হ্যালো সালাম!
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। রাশেদ আমি মকবুল স্যার। সেদিন তোমাদের পরীক্ষায় গার্ড দিলাম।
-ওহ স্যার, স্যার! কেমন আছেন স্যার? ( রাশেদ লাউডস্পিকার অন করলো)
-ভাল আছি। শোন রাশেদ। কাল সকাল সকাল শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু মেহমান আসবে। আমার শ্যালিকা তার নতুন জামাইকে নিয়ে আসবে আর কি। আমাদের আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে কাল ভিসি স্যারের সাথে সারাদিন একটা কনফারেন্স আছে, ফিরতে ফিরতে বিকেল। তোমাদের ম্যাডাম আবার বাজার করতে পারে না। তুমি কি সকাল সকাল আমাকে কিছু জিনিস কিনে দিতে পারবে?
-অবশ্যই অবশ্যই স্যার! বলুন স্যার কি কি লাগবে।
-হুম নোট করো।
আমি সাথে সাথেই মোবাইল বের করলাম। আমাদের দশতম কাস্টমার! আমি আবার রাশেদের ব্যবস্যার এসিস্টেন্ট। গত একমাস হয়ে গেল ব্যাবসা শুরু হয়েছে। এখনো খুব একটা সুবিধা করা যায় নি। আজ মনে হয় একটা দাও মারা যাবে।
স্যার বলতে লাগলেন,
“এক কেজি চিংড়ি। বড় বড়। দুটো দেশি মুরগি। একটা বড় রুই মাছ। জামাই নাকি রুই মাছের মুড়িঘন্ট পছন্দ করে। সো মাছটা একটু ভালমতো কিনতে হবে। আর দুই কেজি প্যাকেটের পোলাও এর চাল। সবজির মধ্যে যা পাও, তোমার যা ভাল লাগে নিয়ে এসো। কেমন?”
-জি স্যার। আপনি কোন চিন্তা করবেন না স্যার! আমি সকাল দশটার মধ্যেই বাজার শেষ করে আপনার বাসায় দিয়ে আসবো।
-আমি ফুলার রোডেই থাকি। ব্লক আর ফ্ল্যাট নম্বর নিয়ে দিচ্ছি ম্যাসেজে। তোমাকে এডভান্স টাকা দিতে হবে নাকি?
রাশেদ নায়ক রিয়াজের মতো ঘার বাঁকা হাসি দিয়ে বললো, “দিলে ভাল হয় স্যার! বিকাশ করতে পারেন এই নাম্বারে!”
……….
পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম রাশেদ নেই। বাজারে চলে গেছে তাহলে। সারাদিন ক্লাস করলাম। সন্ধ্যার দিকে বন্ধুরা মিলে গল্প করছিলাম। রাশেদের কাছ থেকে জানলাম, সেরা বাজার করেছে সে! ক্ষানিকবাদে মকবুল স্যারের কল।
আসসালামু আলাইকুম স্যার!
ওয়ালাইকুম আসসালাম! রাশেদ, আজকে রাতে ফ্রি আছো?
জি স্যার!
অনেক খাবার রয়ে গিয়েছে। তুমি একবার এসো তো। তোমাকে নিয়ে খাই আজ।
রাশেদ শুনে খুশিতে গদ্গদ।
-চল, তোকেও নিয়ে যাই! হাজার হোক, বিজনেসে যুক্ত আছিস!
আমি বললাম, যাব? কিছু মনে করবেন নাতো?
আরে না, স্যার খুবই ভাল মানুষ। পরীক্ষার হলে আর কাওকে সিঙ্গারা খাওয়াতে দেখেছিস?
আমি আর রাশেদ রাত নয়টার দিকে স্যারের বাসায় রওনা দিলাম।
দরজা খুলে দিলেন স্যার নিজেই।
-এসো এসো!
-সালাম স্যার! গেস্টরা চলে গেছেন?
-হ্যা! তোমার এই বন্ধুটির নাম কি?
আমি বললাম, স্যার আমার নাম ইয়াসির।
-বেশ বেশ। চল, খেতে খেতে গল্প করি!
আমরা ডাইনিং টেবিলে বসলাম।
রাশেদ বললো, স্যার, ম্যাডামকে দেখছি না।
-তোমাদের ম্যাডাম তার বোনের সাথেই বের হয়েছে। তোমরা খাও।
-জি স্যার!
বলেই আমরা চিংড়ির কোরমা মুখে দিলাম।
-কি? খাও না কেন?
-ইয়ে মানে স্যার, চিংড়িটা মনে হয় একটু বেশি রান্না করেছে। একটু নরম হয়ে গেছে!
স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, না। গলা চিংড়ি, তাই নরম। মাছটা নাও!
আমি ভয়ে ভয়ে রুই মাছ পাতে তুললাম।
থু করে ফেলে দিলাম। এমন পচা মাছ এর আগে কোনদিন খাই নি, ভবিষ্যতে খাব সেটাও আশা করছি না।
আমি রাশেদের দিকে তাকালাম। সে অনেক কষ্টে রুই মাছ মুখে দিয়ে বসে আছে।
যা ভয় করছিলাম, সেটাই হয়েছে। আমাকে ছাড়া বাজার করে রাশেদ সব নষ্ট আর পচা জিনিস কিনে এনেছে। এখন আবার মনে হচ্ছে স্যারের বউ স্যারের উপর রাগ করেই তার বোনের সাথে চলে গেছেন। হাজার হোক, প্রথমবার নতুন জামাই বাড়িতে এসেছে। তারউপর জামাই এর ডিমান্ড ছিল এই রুই মাছেই!
এক মিনিট কেটে গেল। দুই মিনিট কেটে গেল।
রাশেদ ঢকঢক করে পানি গিলে আমাকে খোঁচা দিয়ে স্যারকে বললো, “স্যার, যাই আজ! এসাইন্মেন্ট আছে!”
স্যার গম্ভীর কন্ঠে বললেন, “অবশ্যই!”
……….
প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে। রাশেদের বাজার ব্যবসা সেই ঘটনার পরপরই বন্ধ হয়েছে। আমরাও সব ভুলে গিয়েছি।
বছর শেষে ভাইভা দিতে গিয়ে দেখি অলৌকিক কারণে মকবুল স্যার আমাদের এক্সটার্নাল হয়েছেন।
বাকিটা ইতিহাস!