বৃহস্পতিবারের শেষ বাসটা বাজারের স্টপেজে এসে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। বাইরে ভয়াবহ ধরনের বৃষ্টি। একটা ছোট ছাতা অবশ্য সাথে আছে, কিন্তু নীলখেত থেকে বড় মেয়ের জন্য প্রাইমারী স্কুল নিয়োগের যে গাইডগুলো সাথে আছে, সেগুলো ভিজে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। বাস যেহেতু লাস্ট স্টপেজে এসে থেমেছে, তাই বসে থাকলেও ক্ষতি নেই- এটা ভেবেই হাকিম সাহেব বাস থেকে নামছেন না। বাসের ড্রাইভার আর কন্ট্রাকটর নিজেরাও আয়েশ করে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঠিক এমন সময়ে কোথায় একটা বজ্রপাতের আলোর ঝলকানিতে সবার নেশাটা ছুটে গেলো। বাসে এই তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই খেয়াল হলে হাকিম সাহেব এই ঝড়বৃষ্টি মাথায় দিয়েই বাস স্টপেজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জীর্নশীর্ন চায়ের দোকানে এসে বসলেন। দোকানটা আগে চালাতো গফুর নামের এক বৃদ্ধ। এখন চালায় তার ছেলে সগির। হাকিম সাহেবের একই গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় বাড়ি সগিরদের। চায়ে চুমুক দিয়েই বুঝলেন সগির একদম তার স্বাদমতোই চায়ে দুধ চিনি মিশিয়েছে। কলেজ জীবন থেকে এই দোকানে আসেন হাকিম সাহেব। যৌবন পেরিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ধরতে চললেও, চায়ের স্বাদটা তাঁর এখনো আগের মতোই প্রয়োজন।
চা শেষ করতে করতে বৃষ্টি থেমে গেলো। সগির বললো, “ভাইজান, দৌড় দেন। নাইলে আরেক রাউন্ড বৃষ্টি আসবো নে।”
হাকিম সাহেবেরও সেটাই মনে হলো। চায়ের বিল মিটিয়ে হাকিম সাহেব প্রায় অন্ধকার এই রাতে মোবাইলের আলো জ্বেলে কাদামাটি পার করতে করতে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। বাড়িতে পৌঁছাতে খুব একটা বেশি সময় লাগে না, কিন্তু গ্রামের এলাকায় বৃষ্টি হলেই লোডশেডিং। তিনি যখন বাড়িতে পৌঁছালেন, স্ত্রী সালেহা বানু ছাড়া আর কেউ সজাগ নয়। এমনিতে সালেহা বানুও রাত দশটার পর জেগে থাকতে পারেন না। কিন্তু প্রতি বৃহস্পতিবারেই সালেহা বানুর রুটিনটা পরিবর্তিত হয়। এইদিন ঢাকা থেকে তার স্বামী দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি ফিরেন। বিশেষ করে বৃহস্পতিবারের রাতে হাকিম সাহেবের পছন্দের মুরগির ঝোল আর টমেটোর চাটনি বানিয়ে সালেহা বানু ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখেন। আজকেও তিনি তাই করছিলেন। হাকিম সাহেব তার হাতে মেয়ের বইগুলো দিয়ে উঠানের টিউবওয়েলে গেলেন হাত মুখ ধুতে। ঘরে মোটরের পানি থাকলেও টিউবওয়েল চেপে ঠাণ্ডা পানিতে তাঁর হাত মুখ ধোয়ার অভ্যাস। এরপর তিনি ড্রয়িংরুমের মেঝেতে চাদর পেতে খেতে বসলেন। তাঁর স্ত্রী টিভি থেকে উঠে এসে মুরগির ঝোল বেড়ে দিতে দিতে বললেন, “খাবার ভালো হয়েছে?”
হাকিম সাহেব খেতে খেতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।
সালেহা বানুর কাছে তাঁর স্বামীর মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। স্বামী ছাড়া কেউ তাকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। সে মনে মনে খুশি হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরো এক টুকরা মুরগি তুলে দিয়ে বললো, “তোমার কি মাহবুব ভাইয়ের কথা মনে আছে?”
– কোন মাহবুব ভাই?
– জানতাম মনে থাকবে না। না থাকারই কথা। সেই কবে আমাদের বিয়েতে দেখা হইছিলো যখন তুমি প্রথমবার আমাদের বাড়িতে আসলা। উনার মা তোমাকে একটা আংটি দিসিলো। তুমি সেটা হারায় ফেলসিলা দুইদিন পরেই। এইবার মনে পড়েছে?
– হ্যাঁ ঘটনা তো মনে পড়েছে। সে যেন তোমার কেমন ভাই?
– আমার বড় চাচীর বোনের ছেলে।
– আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। এতদিন বাদে উনার কথা উঠবার কি কারণ?
– কারণ হলো উনি আমাদের গ্রামের কলেজের প্রিন্সিপাল হইসেন।
– তাই নাকি? আমাদের কলেজে?
– জি। গত সপ্তাহে আসছেন। আজকে উনি বিকালে ফোন করসিলেন। উনিও আসলে আমাদের কথা ভুলে গেসিলেন। উনার বোন আমার চাচাতো বোন মিলির সাথে ফোনে কথা বলতেসিলো। তখন নাকি মিলি মনে করায় দিসে আমাদের কথা।
– তাহলে তো ওনাকে কালকে বাড়িতে দাওয়াত করা উচিৎ।
এ কথা শুনে সালেহা বানুর মনে খুশি লাগলো। সে এতক্ষণ এই কথাই ভাবছিলো। আসলেই তাঁর স্বামীর মতো মানুষ হয় না। সে আরেক পিস মাংস হাকিম সাহেবের প্লেটে তুলে দিলো।
সালেহা বানু বললো, “উনার কিন্তু একটা দারুণ ক্ষমতা আছে।”
– কি ক্ষমতা?
– উনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারেন।
হাকিম সাহেব খাওয়া বাদ দিয়ে তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন। এরপর আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। খেতে খেতে বললেন, “আমি তো স্বপ্নই দেখি না। দিনরাত যে পরিশ্রম হয়, বিছানায় গেলেই ঘুম আসে। আবার তুমি তো বলো আমি বিছানায় গেলেই নাকি নাক ডেকে ঘুম পাড়ি। নাহলে তাঁর ক্ষমতার একটা পরীক্ষা নিতে পারতাম।”
সালেহা বানু হি হি করে হেসে উঠলো। ছেলে মেয়ে উঠে যাবে দেখে মুখে শাড়ী গুঁজে বললো, “হইসে! উঠেন। যান হাত ধুইয়া আসেন। আপনার মাথায় তেল দিয়া দেই। তারপর ঘুমাইয়েন নাক ডাইক্যা।”
পরের দিন কিন্তু হাকিম সাহেবের সাথে মাহবুব সাহেবের দেখা হলো না। এমনকি আগামী কয়েক মাসেও হলো না। দেখা গেলো, হাকিম সাহেব যেদিন বাড়িতে আসেন, ঠিক সেইদিনই মাহবুব সাহেবও তাঁর নিজ বাড়িতে যান। মাহবুব সাহেবের স্ত্রী আর তাঁদের এক ছেলে যেখানে থাকেন, সেখান থেকে তাঁর নতুন কলেজের দূরত্ব প্রায় একশো কিলোমিটার। বছরের মাঝখানে স্কুল ট্রান্সফার হবে না। তাই আরো কিছুদিন এভাবে যাওয়া আসা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এর মধ্যে হাকিম সাহেব এলাকায় এসে টের পেলেন কলেজের এই নতুন প্রিন্সিপাল বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেছেন। অল্পভাষী মানুষ, কিন্তু সবার সাথেই মিশেন, চলেন, এবং কলেজও নাকি ভালই চালাচ্ছেন। কলেজের এইচএচসির রেসাল্ট এবার নাকি ভাল না হয়ে যাবেই না। কিন্তু সবথেকে বেশি যে বিষয়টা নিয়ে সবার মধ্যে বলাবলি হয়, তা হলো প্রিন্সিপাল সাহেবের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার কথা। এলাকার অনেকেই আজকাল তাঁর কাছে স্বপ্নের বিশ্লেষণ জানতে চান। ব্যাখ্যাগুলোও নাকি সত্য বলে অনেকে প্রমাণ পেয়েছে। আজকাল নাকি কলেজের অনেক ছাত্র তাঁদের এইচএসসির কি রেজাল্ট হবে, বা কি স্বপ্ন দেখলে রেজাল্ট কেমন হবে- এসব জানতে প্রিন্সিপালের রুমের সামনে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যদি কোনভাবে প্রিন্সিপালের কাছ থেকে আগাম কিছু জানা যায়!
এই ঘটনার পর আরো মাস দুয়েক কেটে গেলো। হাকিম সাহেব তাঁর অফিসের কাজ নিয়ে এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, প্রতি তিন সপ্তাহ অন্তর অন্তর বাড়িতে আসতে লাগলেন। একসময় তিনি নিজেই নিজের নাক ডাকার আওয়াজ পান বলে সন্দেহ করলেন। এরকম এক ব্যস্ত সময়ে মিরপুরের একটা মেসে আলাদা রুম নিয়ে থাকা হাকিম সাহেব এক পূর্নিমার রাতে অনেক বছর পর একটা স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটা দেখে তাঁর যখন ঘুম ভাঙলো, রাত তখন তিনটা তেরো। বাঁকা চাঁদের আলো মেসের জানালা দিয়ে এসে ঘরে পড়ছে। এই আলোতেই তিনি চশমা খুঁজে নিয়ে ঘরের এক কোণায় রাখা জগ থেকে পানি বের করে পুরো গ্লাস পানি খেয়ে ফেললেন। অনেক কষ্টে সে রাতে ঘুম হলো তাঁর।
এক বর্ষা পার হয়ে আরেক বর্ষা হাজির। স্বপ্নটা কিন্তু হাকিম সাহেবকে ছাড়লো না। অবস্থা এমন হলো প্রায় প্রতিরাতেই স্বপ্ন দেখে উনি জেগে উঠেন। যেদিন গ্রামে থাকেন, স্ত্রীর পাশে শুয়ে থাকার কারণে নড়াচড়া করলে সালেহা বানুও জেগে উঠেন। সালেহা বানুর দিকে তখন হাকিম সাহেব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, কিছুই বলতে পারেন না। এমন যখন অবস্থা, হাকিম সাহেব ঠিক করলেন মাহবুব সাহেবকে তাঁর স্বপ্নের কথাটা বলা যেতে পারে।
সোমবার হাকিম সাহেব আর ঢাকায় ফিরলেন না। কলেজ ছুটি হবার জন্য বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলেন। এরপর নামলো আকাশ কাঁপানো বৃষ্টি। সন্ধ্যায়ও যখন বৃষ্টি থামছে না, হাকিম সাহেবের তা দেখে সহ্যের সীমায় বাঁধ পড়লো। বড় একটা ছাতা নিয়ে কলেজের প্রিন্সিপালের জন্য যে একতলা বাড়িটা হাকিম সাহেব নিজের কলেজ জীবন থেকে দেখছেন, সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন। বাড়িটা পুরনো হলেও এখনো মজবুত। বারবার রং করা হয় বিধায় দেখতে খুব একটা খারাপ লাগে না। বাড়িতে ঢুকবার প্রবেশপথে যে বিশাল বাগানবিলাস গাছ দিয়ে গেট বানানো হয়েছে, আজ তা বৃষ্টিতে ভিজে আছে। সেই গেট পার হয়ে বাড়িতে ঢুকতেই হাকিম সাহেব দেখলেন মাহবুব সাহেবের ঘরের দরজা খোলা, ভিতরে ঘরের আলো জ্বলছে। ছাতা ভাঁজ করে দরজায় দাঁড়াতেই ভেতর থেকে মাহবুব সাহেবকে দেখা গেলো। মনে হচ্ছে তিনি এতক্ষণ হাকিম সাহেবের জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাকিম সাহেবের মনে হলো, মাহবুব সাহেবের চেহারায় পরিবর্তন এসেছে, কিংবা তাঁর নিজেরই আর লোকটার চেহারা মনে নেই। মাহবুব সাহেব সাদা এক পাঞ্জাবী পড়েছেন, চোখে অর্ধগোল চশমা, উচ্চতা ভালো। তাঁকে দেখে হাকিম সাহেবের মনে হলো তাঁর সাথে কার যেন চেহারার মিল আছে। সম্ভবত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেহারার সাথেই মাহবুব সাহেবের চেহারাটার মিল।
মাহবুব সাহেব কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। হাকিম সাহেব বললেন, “আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?”
– হাকিম ভাই না? ওয়ালাইকুম আসসালাম! কী সৌভাগ্য!
– আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
– আপনার বাড়িতে দুইবার যাওয়া হয়েছে এক বছরে। আপনার ছবি দেখেছি দেয়ালে। ভেতরে আসুন ভাই।
হাকিম সাহেব অবাক না হয়ে পারলেন না। ভদ্রলোকের ব্যবহার অমায়িকের চেয়েও বেশি। ঘরের সোফায় বসতে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। ভেতর থেকে এক মিনিটের মাথায় এক কাপ চা নিয়ে এলেন। এক মিনিটের মধ্যে চা বানানো সম্ভব না। হাকিম সাহেব অনুমান করলেন এই চা মাহবুব সাহেব নিজের জন্যই বানিয়েছিলেন। আবার মনে হলো ফ্লাক্সেও তো থাকতে পারে। না, পারে না। থাকলে আরেক কাপ চা নিয়েই বসতেন মাহবুব সাহেব।
– আপনি চা খাবেন না?
– আমি এতক্ষণ খেয়েছি। খালি চা না, সাথে ঝালমুড়ি মেখেও খেয়েছি। বুঝতেই পারেন একা মানুষ! ভাই আপনি কেমন আছেন?
– ভাল আছি। আপনার কেমন লাগছে এখানে? কোন সমস্যা হয় না তো?
– জি না ভাই। কোন সমস্যা হয় না। তবে কলেজের অবস্থা খুব একটা ভাল না। আপনার এলাকার কলেজ, আপনাকে আলাদা করে বলার তো কিছু নাই। কমিটিতে নানা ধরনের মানুষ। সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। কাজটা সহজ না। মাঝেমাঝে আপনার মেয়ে আর ছোট ছেলে খাবার দিয়ে যায়। আপনার কথা প্রায়ই জানতে চাই।
অনেক সময় অব্দি দুজনের কথোপকথন চললো। অথচ হাকিম সাহেব কোনমতেই নিজের স্বপ্নের কথা বলতে পারলেন না। একসময় বিদায় নিয়ে চলে আসতে হলো।
এই সমস্যা হাকিম সাহেবের বহুদিনের। প্রয়োজনের সময় আসল কথা বলতে পারেন না। অফিসেও তাই বিভিন্ন সময়ে তাঁকে উটকো ঝামেলা নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। হাকিম সাহেবের জীবনে এই সমস্যা না থাকলে এতদিনে অনেক উপরে উঠে যেতেন বলে তাঁর ধারনা। প্রায় দশমিনিট এসব ভাবতে ভাবতে হাকিম সাহেব উল্টোপথে আবার প্রিন্সিপাল বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
হাকিম সাহেব আর মাহবুব সাহেব মুখোমুখি বসেছেন প্রায় আধাঘণ্টা যাবৎ। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার লোডশেডিং হয়েছে এবং আপাতত বিদ্যুৎবিহীন মূহুর্ত চলছে। ঘরে মোম জ্বালানো হয়েছে এবং তা ক্ষানিকটা শেষ হয়ে এখনো জ্বলছে। ঘরের জানালা খোলা না হলেও বাইরের বৃষ্টির ঠাণ্ডা বাতাস ফাঁকফোকর দিয়ে দুজনের শরীরে এসে লাগছে। এতক্ষনে মাহবুব সাহেবের চেহারার নরম ভাবটা কাটিয়ে তিনি ক্ষানিকটা গম্ভীর হয়েছেন। অতন্ত্য মনোযোগের কারণে মাঝেমাঝে তাঁর কপাল কুঁচকে অন্ধকারে সেখানে ছায়াও তৈরি হয়েছে। মাহবুব সাহেব পুরো ঘটনা শুনে “সোলেমানি খাবনামা” বইটা হাত থেকে নামিয়ে বললেন, “ভাই, আপনি কি জীবনে কারো কোন ক্ষতি করেছেন?”
– জি না। তেমন কোন ক্ষতি আমি কখনো কারো করি নি।
মাহবুব সাহেব তাঁর থুতনিতে হাত রেখে অনেকক্ষণ শীতল চোখে হাকিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ পর বললেন, “আপনি কি জানেন স্বপ্ন কয়প্রকারের হয়?”
– জি। জানি। একপ্রকার স্বপ্ন আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে যা সুসংবাদ। একপ্রকার আসে শয়তান থেকে। আরেকপ্রকার আসে ক্লান্তিতে, যার কোন মানে থাকে না।
– বাহ। আপনি তো লেখাপড়া করে এসেছেন!
– আমি আসলেই লেখাপড়া করে এসেছি। এই যে তিনপ্রকারের স্বপ্নের কথা বললাম এই কথা বলেছেন নবী সঃ।
– নবীজির কাছ থেকে এই কথা আমাদের কে বলেছেন তাঁর নাম জানেন?
– না।
– একথা নবীজির কাছ থেকে বলেছেন আবু হুরায়রা রাঃ।
– আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা কি হতে পারে বলে আপনার জ্ঞান বলছে?
– আমি তো ভাই জ্ঞান থেকে কথা বলি না। আমি কথা বলি অতীত থেকে।
– মানে?
মাহবুব সাহেব হাসলেন। হেসে বললেন, “আমি মানুষকে আগে বুঝতে চেষ্টা করি। তারপর বুঝতে চেষ্টা করি এই স্বপ্ন কোন প্রকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু স্বপ্ন আমাদের নিজেদের জীবনের সাথে জড়িত।”
– কিরকম?
– এই ধরেন যারা আমার ছাত্র। এদের চিন্তা হচ্ছে পরীক্ষার রেজাল্ট। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তারা পরীক্ষা নিয়ে উদ্ভট স্বপ্ন দেখে ঘাবড়ে যায়। এমনকি আমি নিজেও ইন্টার পরীক্ষার আগে অংক পরীক্ষায় ফেইল করার স্বপ্ন দেখতাম। এটা কিন্তু তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন স্বপ্ন না। আমার তো মনে হয় বাংলাদেশে এমন কোন ছাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না যে অংক পরীক্ষায় ফেইল করার স্বপ্ন দেখেনি!
হাকিম সাহেব হতাশই হলেন। এই জিনিসের জন্য সারা গ্রামের মানুষ পাগল হয়ে আছে?
– আপনার স্বপ্নের একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আমি দিতে পারি। কিন্তু তাঁর আগে আপনার অতীত আমাকে জানতে হবে।
– অতীত?
– সময় জিনিসটা আমাদের জীবনে যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ন, তা বলে বুঝানো যাবে না ভাই। সহজ করে বলি। ধরেন আপনার জন্ম হয় নাই, তাহলে কি আজকে আপনি আমার সামনে বসে থাকতে পারতেন? পারতেন না। যার অতীত সময় বলে কিছু নেই, তার বর্তমানের কোন পরিচয় নেই। অতীত না থাকলে আপনার আজকে কোন পরিচয় থাকতো না। অতীতে আপনি জন্মেছিলেন বলেই আজ আপনি বর্তমানে আছেন।
– জি। এখন আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমার অতীত স্মৃতির কারণে আমি এই স্বপ্ন দেখছি? আর কোন রহস্য নেই?
– আমি তা পুরোপুরি বলতে চাই না। এই স্বপ্ন শয়তানও আপনাকে দেখাতে পারে। আমি কেবল আপনাকে একটা সম্ভাবনার কথা বললাম।
– জি।
– আপনি প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে চলেছেন একটি কময়বসী মেয়েকে। মেয়েটিকে দেখলে আপনার মনে অপরাধবোধ কাজ করে, ভয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। তাই তো?
– জি।
– সবচেয়ে লজিক্যাল কথাটি হলো আপনি অতীত জীবনে কারো সাথে এমন কিছু করেছেন যা হঠাৎ করে আপনার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এমন অনেক সময় হয়।
– জি। আপনার কথা যুক্তিসংগত।
– যদিও আমি সাইকোলজিস্ট না। হলে হয়তো বললাম, সেই পুরনো ঘটনা আপনার ব্রেইনের কোন এক কোষে জমা হয়েছিল। তা আজ সচল হয়ে আপনাকে ট্রমাতে নিয়ে গেছে।
হাকিম সাহেব চুপ করে বসে আছেন। মাহবুব সাহেবের জীবনে এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। হয়তো স্বপ্নটা তেমন কিছুই না। কিন্তু অতীতের কথা বললে বেশিরভাগ মানুষই থমকে যায়। অতীতহীন মানুষের গল্প তিনি জানেন না।
– আপনি কিছু মনে করবেন না ভাই। আমাকে ভয়ও পাবেন না। আপনার স্ত্রীকে আমি কিছু জানাবো না। আপনি শান্তভাবে কথা বলতে চাইলেন আমি শুনতে পারি। হয়তো আমি আপনাকে আসলেই কোনভাবে সাহায্য করতে পারি। এই দুঃস্বপ্ন দেখাটা থামাতে পারি।
শেষ কথাটা শুনে হাকিম সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। তিনি বললেন, “ভাই, আরেক কাপ চা খাওয়াবেন?”
মাহবুব সাহেব জানালা খুলে দিয়ে দুইকাপ চা নিয়ে এলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে হাকিম সাহেব বলতে লাগলেন।
– আপনি যে কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছেন, আমি সেই কলেজেই লেখাপড়া করতাম। সেসময়ে আমি দেখতে সুদর্শন ছিলাম। একদিন রংপুর থেকে আমাদের ক্লাসে একটি মেয়ে এসে ভর্তি হলো যাকে আমার ভাল লাগলো। মেয়েটিও আমাকে পছন্দ করতে শুরু করে। একসময় আমাদের প্রণয় হয়। সেইসময়ে একটি মেয়ে যেভাবে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে পারতো, একটি ছেলে কিন্তু পারতো না। মেয়েটি প্রণয়ের পরিণয় চেয়েছিলো। আমি কিন্তু এতদূর ভাবি নি। ভাবতেও পারি নি। মেয়েটি প্রতিদিন আমাকে একটা করে চিঠি দিতো। সেই চিঠিগুলো পড়লে পাথরের মনও গলে যাবে। কিন্তু আমার আসতো হাসি। তাঁর আবেগের মর্যাদা আমি না দিলেও সে আমাকে ছাড়তে চাইলো না। নানাভাবে আমাকে তার ভালবাসার দিকে টানতে চাইলো। আমি কিন্তু মজলাম না। একসময় তাঁকে প্রচণ্ড অপমান করা শুরু করলাম। সে কিন্তু সুন্দরী ছিল। যেখানে আমার বন্ধুরা মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য ব্যকুল ছিল, একদিন তাদের সামনেই মেয়েটাকে চরমরকম অপমান করলাম। অপমান করেও ক্ষান্ত হলাম না। মেয়েটাকে টানতে টানতে তার বাবার কাছে নিয়ে বলে বসলাম- মেয়েকে সামলান। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটি চোখ তুলে আমার দিকে আর তাকাচ্ছে না। তার বাবা সবার সামনেই তাকে চড় মেড়ে বসলো। যুবতী মেয়ে, হয়তো অপমানটা বেশীই লেগেছিল।
– তারপর?
– তারপর কি হয় আমি আসলে জানি না।
– কেন?
– পরদিন যখন ক্লাসে গেলাম, মেয়েটি আসে নি। এমনকি আর কোনদিন মেয়েটিকে দেখিনি। কিছুদিন পর জানতে পারলাম, মেয়েটির বাবা তাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। হয়তো নিজেদের এলাকায়, রংপুরে।
মাহবুব সাহেব চুপ থেকে বললেন, “আপনাদের মাঝে আর কোন সম্পর্ক হয়েছিলো?
– না।
– সত্যি নাকি?
– সত্যিই আমাদের আর কোন সম্পর্ক ছিলো না। আর আমার যে মোহ ছিল তা অনেক আগেই কেটে গিয়েছিলো।
– তারপরেও এতদিন পর এসে আপনি এমন সব স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন?
– জি।
– আপনি তো ভাই আমাকে এখন বিপদে ফেলে দিলেন। এতক্ষণ মনে মনে সাজিয়েছিলাম কি করতে বলবো আপনাকে, এখন তো আবার নতুন করে ভাবতে হবে।
মাহবুব সাহেব গালে হাত দিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেন। হাকিম সাহেব এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যে প্রিন্সিপালের চেহারাটা আসলেই মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো। মাহবুব সাহেব বললেন, “আমার মনে হয় আপনার উচিৎ সেই মেয়েটাকে খুঁজে বের করে তাঁর কাছে একবার মাফ চেয়ে নেয়া। তাহলে সম্ভবত আপনি এই ট্রমা থেকে বের হতে পারবেন।”
হাকিম সাহেবের মনে হলো এই পরামর্শ পছন্দ হলো না। তিনি বললেন, “কাজটা আসলে ঠিক হবে বলে মনে হয় না। এতদিনে তাঁর বিয়ে হবার কথা, সন্তান হবার কথা। আমার নিজের মেয়েকেই তো বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি।”
– না, তা হয়তো হয়েছে। আমরা এতক্ষণ যাকে কমবয়সী মেয়ে বলে সম্বোধন করছি, তিনি আজকে মধ্যবয়স্কা মহিলা হয়েছেন তা সত্য। কিন্তু আপনার স্মৃতি যেমন আছে, তাঁরও আছে। হয়তো একবার আপনারা দেখা করে বিষয়টা মিটিয়ে নিতে পারেন।
– তাঁর কোন ঠিকানা আমার কাছে নেই।
– খোঁজ করলে পাওয়া যাবে না? ফেইসবুক? এখন তো অনেকেই ফেইসবুক চালায়।
– মনে হয় পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলেই মনে হয় ভাল হয়।
সেদিন বিদায় নেবার আগে মাহবুব সাহেবের যে কোমল হাসি হাকিম সাহেব দেখেছিলেন, সেটাই সারা পথ তাঁর মনে গেঁথে রইলো।
হাকিম সাহেব এরপর ফেইসবুকে খোঁজ করলেন, পুরনো বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করলেন। সব জায়গায় চেষ্টা করেও যখন তিনি কোন খোঁজ পেলেন না, আরেক সন্ধ্যায় তিনি আবার হাজির হলেন প্রিন্সিপালের বাড়িতে। দুবার দরজায় টোকা দিতেই মাহবুব সাহেব দরজা খুলে দিলেন। হাকিম সাহেব বললেন, “ভাই আপনি কি আমাকে একটা উপকার করতে পারবেন?”
পরদিন সকালে হাকিম সাহেব মাহবুব সাহেবের কলেজে উপস্থিত হলেন। পিয়নকে ডেকে পঁচাশি সালের রেকর্ড বই বের করতে বললেন মাহবুব সাহেব। এরপর একে একে সেই বছরের পাতা উল্টে হাকিম সাহেব একটি নাম আর ছবিতে এসে আঙ্গুল রেখে থামলেন। প্রিন্সিপাল মাহবুব সাহেব সেই ছবিটা আর নামটা ভালমতো তাকিয়ে দেখলেন। আফসানা রহমান মিমি। এর ঠিক নিচেই দেয়া আছে বর্তমান ঠিকানা, তার পাশেই লেখা স্থায়ী ঠিকানা।
প্রিন্সিপালকে নিয়ে সেদিন রাতেই ঢাকা এসে হাকিম সাহেব চললেন সেই স্থায়ী ঠিকানায়। রংপুরের ট্রেনে চেপে সেই ঠিকানায় পরদিন পৌঁছে কাউকে পাওয়া গেলো না। তবে আশেপাশের মানুষ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেলো। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মাহবুব সাহেব জবাব দেন, “আমরা শ্রীনগর কলেজ থেকে এসেছি। আমি শ্রীনগর কলেজের প্রিন্সিপাল। কলেজের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে আফসানা নামের মানুষটিকে আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন।” অবশেষে আফসানার ঠিকানা পাওয়া গেলো। রংপুর থেকে তারা চলে এলেন সুদূর খুলনা।
দেখা হবার আগে হাকিম সাহেব জানেন, আফসানা এখন বিবাহিতা, এক কন্যার জননী, এবং চমৎকার এক ইঞ্জিনিয়র স্বামীর সংসারের কর্তী। মাহবুব সাহেব খুলনা শহরে এসে ঠিক বাড়ির ঠিকানাটা বের করে ফেললেন। দোতলা বাড়ি। এই বাড়ির সামনেও আছে লাল বাগানবিলাশ। মাহবুব সাহেব বাড়ির পাশের চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসলেন। এতদূর জার্নি করার অভ্যাস তাঁর নেই। এক কাপ লাল চা চেয়ে তিনি দেখলেন, হাকিম সাহেব বাগানবিলাশের ভেতর দিয়ে দোতলা বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
হাকিম সাহেব দোতলায় প্রবেশ করে কলিং বেল চাপলেন। দরজা যখন খুললো, হাকিম সাহেব শাড়ি পড়া এক অর্ধবয়সী মহিলাকে দেখে অপরাধীর ভঙ্গিতে চেয়ে রইলেন। ভিতরে ঢুকবার অনুমতি চাইতে পারলেন না।
বিশটা মিনিট পার হয়ে যখন সময় একুশ মিনিটে পড়লো, চায়ের দোকানে বসা মাহবুব সাহেব বুঝলেন হাকিম সাহেব ভিতরে ঢুকবার অনুমতি পেয়েছেন। প্রায় এক ঘণ্টা পার করেও যখন তিনি ফিরলেন না, মাহবুব সাহেব বুঝলেন বাড়িতে আফসানা বাদে আর কেউ নেই। দেড় ঘণ্টা পর হাকিম সাহেব আবার যখন বাগান বিলাশের ভেতর থেকে বাইরের রাস্তাটায় এসে দাঁড়ালেন, মাহবুব সাহেব এমনভাবে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন, যেনো এতক্ষণ যা যা হয়েছে সবই তিনি দেখতে পেয়েছেন। তবুও তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ক্ষমা পেয়েছেন?”
হাকিম সাহেব কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন উত্তর মাহবুব সাহেব বুঝলেন না। আর বুঝার চেষ্টাও করলেন না। হাকিম সাহেবের ক্ষমা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে তাঁর আর মাথা ব্যথা নেই। তাঁর দায়িত্ব এখানেই শেষ।
এই ঘটনার পর হাকিম সাহেব অনেকদিন আর মাহবুব সাহেবের সাথে দেখা করলেন না কিংবা করতে পারলেন না। মাহবুব সাহেব তাতে কিছুই মনে করলেন না, বরং তিনি মনে করলেন সেটাই উচিৎ। তাঁদের পুনরায় দেখা হলো তৃতীয় বর্ষায়। হাকিম সাহেবের মেয়ের বিয়েতে। বরপক্ষ যখন খাওয়া শেষ করে আনন্দ করছে, হাকিম সাহেব দূর থেকে দেখছিলেন। মাহবুব সাহেব তাঁর কাছে আসতেই তিনি লজ্জাবোধ করলেন। মাহবুব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই কেমন আছেন? আর কি সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন?”
– না। আর দেখিনি।
– তাহলে তো ভালই হয়েছে।
– জি ভাই। আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুব সাহেব মৃদু হাসলেন। হেসে বললেন, “আমার একটা কথা মনে হয়। যদি কিছু মনে না করেন তবে বলি?” কথাটা বলে হাকিম সাহেবের উত্তরের আশা করলেন না।
– আমার মনে হয় আপনি আমাকে একটা জিনিস মিথ্যা বলেছেন। আপনি কোন স্বপ্নই দেখেননি। পুরো বিষয়টা আমাকে বানিয়ে বলেছেন।
– আপনার একথা কেন মনে হয়?
– এই এক বছরে আপনার অতীত জানার চেষ্টা করেছি। বলেছিলাম না? ব্যাখ্যা জানতে হলে আগে অতীত জানতে হয়?
হাকিম সাহেব কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। সেই সুযোগে মাহবুব সাহেব বলতে শুরু করলেন।
– আপনার আসলে প্রয়োজন ছিল মেয়েটির ঠিকানা। আর কিছু না। আপনি কোন স্বপ্নই দেখেননি কখনো, নিয়মিত সেটা দেখতে পাওয়া তো পরের কথা। আপনার ছেলের কাছ থেকে জেনেছি আপনি ঘুমালে প্রচণ্ড নাক ডেকে ঘুমান। মানুষ যখন নাক ডাকে, তখন সে গভীর ঘুমে থাকে। সাধারণত সেইসময় স্বপ্ন দেখা হয় না। আপনার স্ত্রীও বলেছেন, আপনি স্বপ্নটপ্ন খুবই কম দেখেন। তাও ধরে নিয়েছিলাম যে আপনি বারবার এক স্বপ্ন দেখছেন, কিন্তু আমি আপনার কলেজ জীবনের কিছু বন্ধুদের সাথে আলাপ করেছিলাম। তারা কথাপ্রসঙ্গে আমাকে জানিয়েছে আপনি অনেক আগেই সেই মেয়েটার ঠিকানা খোঁজ করতে শুরু করেছিলেন। আপনি স্বপ্ন দেখা ছাড়াই আপনার অপরাধবোধে ধরা পড়েছিলেন, কিন্তু আপনার হাতে মেয়েটির ঠিকানা বের করার কোন রাস্তা ছিল না। কাজেই যখন আপনি জানলেন আমি এই কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছি, আপনি একটা সুযোগ পেলেন। আপনার মনে পড়লো, আমি কলেজের পুরনো ছাত্রছাত্রীদের তালিকার মতো সেনসিটিভ জিনিস বের করে দেয়ার ক্ষমতা রাখি। এরপর যখন শুনলেন আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারি, আপনি তখন সময় নিয়ে এই প্ল্যান করলেন। প্রায় এক বছর অপেক্ষা করে তারপর আমার কাছে আসলেন যেনো আমি ধরতে না পারি যে আপনি কেবল ঠিকানা নেবার উদ্দেশ্যে আমার কাছে এসেছেন। এক বছর অপেক্ষা করে আপনি আমার মনে এই ধারনা দিতে চেয়েছিলেন যে, আপনি আসলেই একই স্বপ্ন বারবার দেখেন। আর কিছু না।
হাকিম সাহেব ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন। প্রিন্সিপাল মাহবুব সাহেবের প্রতিটি কথা সত্য। বাড়িভর্তি মানুষ, তাই হাকিম সাহেব কোন উত্তেজনা দেখাতে পারলেন না। মৃদুস্বরে বললেন, “ভাই, গতকাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমার মেয়েটা আমার কাছে এসে কাঁদছে। কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না।”
মাহবুব সাহেব কিছুক্ষণ আবেগহীন দৃষ্টিতে থেকে হাকিম সাহেবের দিকে তাকালেন। এরপর বললেন, “ভাই, এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে যাই। এবার আর যুক্তি খুঁজবেন না। মিলিয়ে নেবেন। আপনার মেয়ের সুখের সংসার হবে। কিন্তু তার প্রথম সন্তান বাঁচবে না।”
আশেপাশ থেকে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। মেয়ের জন্য পালকি এসেছে। হাকিম সাহেবের চোখে জল।
স্বপ্ন বিশারদের কথা তাঁর বিশ্বাস হয়েছে।
শুনুনঃ https://youtu.be/6XC21vKBLEA?si=mdhWsTILFYbC5N5K